– গোলাম মোহাম্মদ কাদের –
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ জোর করে নির্বাচনে নিয়েছে। এতে জাতীয় পার্টি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমি কি মন্ত্রী হতে নির্বাচনে গিয়েছি? আমি তো ২০০৮ সালে মন্ত্রী ছিলাম। তখনকার প্রধানমন্ত্রীর সাথে মতবিরোধের কারণে, পদত্যাগ করেছিলাম। আমি কখনো মন্ত্রীত্বের জন্য রাজনীতি করি না। ২০১৪ সালের নির্বাচন জাতীয় পার্টি বর্জন করেছিলো। ৩০০ আসনের মধ্যে আমিসহ ২৭০ জনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করা হয়েছিলো। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যাইনি এবং সংসদেও যাইনি। তখন আওয়ামী লীগ আমাকে মন্ত্রীত্ব দিতে চেয়েছিলো, আমি রাজী হইনি। আমরা জনগণের কোন ক্ষতি করিনি, জনগনের উপকার করতে চেষ্টা করেছি। ২০১৪ সালে যখন আমরা নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন আরেকটা গ্রুপ বানিয়ে তাদের লাঙ্গল মার্কা দিয়ে নির্বাচনে নেয়ার ব্যবস্থা করেছিলো সরকার। আমি বিশ^াস করিনি তাই ২০২৪ সালের নির্বাচনে আমরা ২৭০ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছিলাম।
মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের বনানীস্থ কার্যালয়ে জাতীয় মহিলা পাটি নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় গোলাম মোহাম্মদ কাদের এ কথা বলেন।
২০২৪ সালের নির্বাচন আমরা বর্জন করতে চেয়েছিলাম। আমাদের বাধ্য করা হয় নির্বাচনে যেতে, এটা সবাই জানে। ১৭ ডিসেম্বর ছিলো প্রার্থীতা প্রত্যাহারের শেষ দিন, আমরা সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার লোকজন আমাদের অফিস ঘেরাও করে রাখে। আমাদের সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জন করতে দেয়নি। জোর করে নির্বাচনে নেয়ার কারনে আমাদের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমরা জনগনের প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচন বর্জন করতে পারিনি। আওয়ামী লীগের পতন না হলে আমাদের দল বিলিন হয়ে যেতো। আওয়ামী লীগের পতন না হলে কোন দলই বাংলাদেশে থাকতো না। শুধু, আওয়ামী লীগ থাকতো। আমরা কখনোই আওয়ামী লীগের দোষর ছিলাম না, আমরা সব সময় জনগনের দোষর ছিলাম। জাতীয় পার্টির সাথে বিএনপির আদর্শগত মিল আছে কিন্তু চরিত্রগত কোন মিল নেই। জাতীয় পার্টিকে সব সময় ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে জাতীয় পার্টি নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। সেই ষড়যন্ত্র এখনও চলছে।
গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের শাসন। গণতন্ত্র মানে হচ্ছে জনগণের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জেলে থেকেই ৫টি আসনে জয়লাভ করেছিলো। ৫টি আসনের জনগণ এরশাদকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছে, তাকে আপনারা কিভাবে স্বৈরাচর বলেন? আপনি যদি গণতন্ত্রমনা হন, তাহলে এরশাদকে কখনোই স্বৈাচার বলতে পারবেন না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন জননন্দিত নেতা। কোন নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। প্রতিটি নির্বাচনে জনগণ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচিত করে জানিয়ে দিয়েছেন, এরশাদ কখনোই স্বৈরাচার ছিলো না। ৯১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি মাঠে থাকতে পারেনি, তারপরও এরশাদ সাহেব জেলে থেকেই ৫টি আসনে জয়ী হয়েছেন। জাতীয় পার্টি ঐ নির্বাচনে ৩৬টি আসনে জয়ী হয়েছিলো।
অনেকেই বলেন, আমরা নাকি আওয়ামী লীগকে দানব বানিয়েছি। আমাদের সমর্থন না পেলে আওয়ামী লীগ দানব হতো না? আমরা বিএনপিকে সমর্থন দিলে বিএনপি দানব হতো না? আওয়ামী লীগ সুযোগ পেয়েছে দানব হয়েছে। আমরা কোনো দলকে দানব বানাতে সমর্থন করিনি। কোনো দল যদি দানব হয়ে থাকে তাহলে তারা নিজেদের দোষেই দানব হয়েছে। আবার কোনো দল সুযোগ পেলে যে দানব হবে না তা কি বলা যায়?
এখন যারা বড় বড় কথা বলছেন, তারা আওয়ামী লীগের আমলে কতজন কথা বলতে পেরেছেন? আওয়ামী লীগের উল্টা কথা বলার পরে যদি আওয়ামী লীগ পরের দিন আপনাকে আবার সেই কথার উল্টা কথা বলতে বলতো, না বলে পারতেন? আওয়ামী লীগ উঠিয়ে নিলে আপনিও জয়বাংলা বলতেন। অনেকে জয়বাংলা বলেছে না? আমরা আমাদের কথা বলে গেছি, আমরা জনগনের পক্ষে কথা বলেছি। আমাদের বিরোধীদল করা হয়েছিলো, আমরা ইচ্ছেমত সরকারের সমালোচনা করতে পেরেছি।
২০২৪ সালের নির্বাচনে আমরা যাইনি। আমাদের কিছু লোককে বাধ্য করে নির্বাচনে নেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তো বিএনপি অংশ নিয়েছিলো। মার্কা ছিলো না কিন্তু ২ ধাপ পর্যন্ত বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো। ২০১৮ সালে বিএনপিসহ সকল দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো, আমরাও নির্বাচনে ছিলাম।
নির্বাচনের কারণে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে? আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে তাদের দুর্নীতি ও দুঃশাসনের জন্য। বৈষম্য সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ শোষন, লাঞ্চনা ও বঞ্চনা করে মানুষকে বিরক্ত করেছিলো। নির্বাচনে বৈধতার জন্য আওয়ামী লীগের পতন হয়নি। শেখ হাসিনার গোয়ার্তুমীর জন্য আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। মানুষ বিরক্ত হতে হতে এমন অবস্থায় গেলো যে জীবন দিতে হলেও ফিরবো না। আমি সংসদে বারবার বলেছি, দেশের মানুষ বৈষম্যের বিরুদ্ধে যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। মুঘল, ব্রীটিশ ও পাকিস্তান আমলেও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ জীবন দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিলো বৈষম্যের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগের পতনে কোন রাজনৈতিক দলের কৃতিত্ব নেই। অনেক দলতো নির্বাচন বন্ধ করতে চেয়েছিলো, পেরেছিলো? অনেক দল নির্বাচনে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু সরকারই তাদের নামে বিভিন্ন মামলা দিয়ে নির্বাচনে থেকে দূরে রেখেছিলো। নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের পতন হয়নি, আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে তাদের দুর্নীতি ও দুঃশাসনের জন্য। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে, এই কৃতিত্ব ছাত্র-জনতার।
২০০১ সালে আমরা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সঙ্গে ছিলাম না। আমরা আলাদাভাবে নির্বাচন করেছিলাম। ঐ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করেছিলো। তখন তারা র্যাব গঠন করে বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড করেছিলো, দলীয়করণ করেছিলো আবার দলীয় লোক দিয়ে তত্বাবধায়ক সরকার তৈরী করেছিলো। এর ফলে এক-এগারো এসেছিলো। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমাদের ছাড়াই আওয়ামী লীগ ব্যাপক সংখ্যগরিষ্ঠতা পেয়েছিলো। জনগণের প্রত্যাশা দেখে আমরা তখন আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি দশগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডে সারা বিশে^ দুর্নাম কুড়িয়েছে আর দলীয়করণের মাধ্যমে দেশ বিভক্ত করেছিলো। ইচ্ছেমত সংবিধান সংশোধন করেছিলো আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে সরকার গঠন করে দেশ চালিয়েছে স্বৈরাচারি কায়দায়। দুটি দলই দেশের মানুষকে বিরক্ত করেছিলো। ক্ষমতায় না এসেও কিছু সংখ্যক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগের চরিত্র ধারণ করেছে। জাতীয় পার্টি সব সময় দেশের মানুষের পক্ষে থেকেছে।
জেনারেল মঞ্জুর হত্যার ১৪ বছর পর এরশাদ সাহেবের নামে হত্যা মামলা দেয়া হয়েছিলো। অন্তত ২০ বার এই মামলার যখন চুড়ান্ত রায় ঘোষণার সময় হয়েছে, তখনই বিচারক পরিবর্তন করে আবারো নতুন করে শুনানি করার নামে মামলাটি জিইয়ে রাখা হয়েছে। মঞ্জুর হত্যা মামলাটি ছিলো হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যু পর্যন্ত। ১৪ সালের পর থেকে জাতীয় পার্টিকে ব্ল্যাকমেইল করে নির্বাচনে নেয়া হয়েছে। জাতীয় পার্টির মাঝে আলাদা দল তৈরী করেও ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। যখন বলা হয়েছে এরশাদ জননিন্দিত হয়ে চলে গেছেন, তখন জনগণ তাকে ৫টি করে আসনে জিতিয়ে প্রমান করেছে এরশাদ সাহেব জননন্দিত।
প্রেসিডিয়াম সদস্য নাজমা আক্তারের সভাপতিত্বে এই মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট মোঃ মুজিবুল হক চুন্নু।
অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব মীর আব্দুস সবুর আসুদ, অ্যাডভোকেট মোঃ রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, মনিরুল ইসলাম মিলন, প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসরুর মওলা, জসীম উদ্দিন ভূইয়া, পার্টি চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মেহেরুন্নেসা খান হেনা পন্নী, মোঃ খলিলুর রহমান খলিল, ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা মহসিন, ভাইস চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ সেলিম, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য আবু জাফর মোঃ ওয়ালীউল্লাহ চৌধুরী মাসুদ, মাসুদুর রহমান মাসুম, এম এ রাজ্জাক খান, ইঞ্জিনিয়ার এলাহান উদ্দিন, যুগ্ম সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য অধ্যাপক নূরুল আমিন শিকদার ভুট্ট, এডভোকেট মোঃ তারেক, মামুনুর রহিম সুমন, মাহমুদ আলম, সমরেশ মন্ডল মানিক, কেন্দ্রীয় সদস্য সামসুল হুদা মিঞা, এ কে এম নুরুজ্জামান জামান, ওয়াহিদুর রহমান ওয়াহিদ, জোনাকি মুন্সি, শেখ হুমায়ুন কবির শাওন, আনোয়ার হোসেন খান শান্ত।
মহিলা পার্টির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ডাঃ সেলিনা খান, জেসমিন নূর প্রিয়াঙ্কা, তাসলিমা আক্তার রুনা, সীমানা আমির, ফরিদা সিকদার, মিথিলা রওয়াজা, জোসনা আক্তার, পারুল বেগম, রোকসানা পারভীন রুমি, তানজিনা আহমেদ, সাফিয়া পারভীন, শামীমা সুলতানা, রীমা বেগম, রিলু বেগম, সাদিয়া পারভিন, ফেরদৌসি বেগম, শাহীনুর আক্তার, ফেরদৌসি বেগম, শান্তা ইসলাম, বিথি আক্তার, রায়সা মাহিম কনা।
মন্তব্য