ঈদের যাত্রায় সাবধান থাকতে হবে। যাত্রীরা অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে বসেন, এমনকি জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে হয়ে। সুতরাং এ ব্যাপারটি ভুলে গেলে চলবে না। যাত্রাপথে অপরিচিত কারও দেওয়া কিছু খাবেন না। কাউকে সন্দেহ হলে ভদ্রতার সঙ্গে এড়িয়ে চলবেন।
গ্রামের বাড়িতে গেলে ছোট শিশুদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখবেন। বাড়ির আশপাশে পুকুর-ডোবা থাকলে শিশুদের কিছুতেই একা ছাড়বেন না। বাড়ির বয়স্করা নিয়মিত যে ওষুধ সেবন করেন, তা পর্যাপ্ত পরিমাণে সঙ্গে নিন ঈদ যাত্রায়। ফাস্ট এইড ওষুধ যেমন-খাবার স্যালাইন, প্যারাসিটামল, অ্যালার্জি প্রতিরোধক ওষুধ, আমাশয় ও হজম রিলেটেড ওষুধ আগে ভাগেই সংগ্রহ করে রাখা ভালো। যাতে কোনো সমস্যা হলে তার আসু সমাধান করা যায়। তবে সবার আগে প্রথমেই প্রি-জার্নি প্লানিং করে নিতে হয়। প্রি-জার্নি প্লানিংয়ে যা করতে হবে তা হলো-
* জার্নি শট না লং ডিসটেন্স হবে সেটা ভাবনায় রাখুন। সাধারণত ৪-৬ ঘণ্টার বেশি সময়ের জার্নিং লং ডিসটেন্স ধরা হয়।
* কী ধরনের খাবার জার্নিতে সঙ্গে নিতে হয়, পানি বা পানীয়ও কেমন হওয়া উচিত।
* পোশাকের ধরন কেমন হবে।
* হঠাৎ বা তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলায় কী করণীয়।
* সুখকর ভ্রমণের জন্য কী করা যায়।
* রোগীরা জার্নি করলে কোনো বিশেষ দিক লক্ষ রাখতে হয় কি না।
এসব কিছুর সমাধান জেনেই জার্নি শুরু করতে হয়। লক্ষ রাখতে হবে, জার্নির স্ট্রেস বা স্ট্রেন যেন শারীরিক সমস্যার কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।
দীর্ঘ সময়ের ভ্রমণে
৪-৬ ঘণ্টার বেশি জার্নির জন্য অন্তত ৩০ মিনিট ব্রেক দরকার। এ সময় ৫-১০ মিনিট হালকা হাঁটাচলা করা উত্তম, এতে দেহে রক্তসঞ্চালন ভালো হবে। শুধু তাই নয়, এ সময় ডায়াবেটিক রোগীরা গ্লুকোমিটার দিয়ে রক্তের সুগার চেক করে নিতে পারেন। যদি সুগার ২ মিলি মোল/লিটার বা এর কম আসে, তবে সঙ্গে রাখা লজেন্স বা চিনি বা মিষ্টি বিস্কুট জাতীয় কিছু খেয়ে নিতে হবে। এছাড়া সুগার চেক করে প্রয়োজন মতো ইনসুলিনও নেওয়া যায়। যারা হার্টের রোগী, তারা এ ফাঁকে হালকা কিছু খেয়ে অ্যাসপিরিন জাতীয় ট্যাবলেট খেতে পারেন। অনেক সময় ধরে ভ্রমণে পানিস্বল্পতা বা ডিহাইড্রেশন হতে পারে। এসি বাস বা প্লেনে ঠান্ডা থেকে এ ডিহাইড্রেশন হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাই মিনারেল ওয়াটার বা ক্যান বা বোতলের কোল্ডড্রিংকস খাওয়া যেতে পারে। এ অবসরে টয়লেটও সেরে নেওয়া যায়।
দীর্ঘ সময়ের জার্নি অনেক সময় বিরক্তিকরও বটে। তাই প্রিয় ম্যাগাজিন বা বইটি সঙ্গে নিতে পারেন। অন্যের বা পাশের কারও যেন ডিস্টার্ব না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে হেডফোন, আইপড, এমপিথ্রি দিয়ে গানও শুনতে পারেন।
> হোমমেড খাবার সঙ্গে রাখুন
জার্নির শুরুতে হালকা খাবার খেয়ে নিতে পারেন। শুকনো খাবার যেমন- প্যাকেট বিস্কুট জার্নিতে সঙ্গে নিন। যেসব ফল ছিলে খাওয়া যায়, যেমন- কমলা, কলা ইত্যাদি ভ্রমণে খাওয়া স্বাস্থ্যকর। এ থেকে জীবাণু সংক্রমণের সুযোগ কম। অন্য ফল খেলে মিনারেল ওয়াটার দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। ভ্রমণে রাস্তায় তৈরি খাবার একদমই খাওয়া যাবে না। আরেকটি দিক লক্ষ রাখবেন, অপরিচিতজন থেকে কোনো খাবার অবশ্যই খাবেন না। খাবারে চেতনাশক মিশিয়ে যাত্রীর মালপত্র ছিনতাইয়ের ঘটনা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। পাশে যে বসল, তার দিকেও লক্ষ রাখুন।
বাচ্চারা যে কোনো যাতায়াতে ঘন ঘন খেতে চায়। তাহলে প্যাকেটে করে চিপস, বিস্কুট নিতে পারেন। যদি ড্রিংকস খেতে চায় তবে ক্যান বা বোতলেরটা খাবে। শিশু এবং বড়রা কুলি করা, ব্রাশ করা, এমনিকে মুখ ধোয়ার সময়ও মিনারেল ওয়াটার ব্যবহার করুন।
বয়স্ক এবং মহিলারা যে কোনো জার্নিতে বেশি করে পানি বা পানীয় পান করুন। ঢিলেঢালা, সুতির কাপড়ই ভ্রমণে পরা উচিত। আন্ডারগার্মেন্ট যথেষ্ট থাকতে হবে, কারণ নোংরা, ময়লা, ঘর্মাক্ত ও কাপড় থেকেই ইনফেকশন হতে পারে। জুতাও যেন লুজ থাকে সেদিকে লক্ষ রাখুন। লম্বা জার্নির ক্ষেত্রে মোজা চেঞ্জ করুন।
> জার্নিতে সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিরোধ
এ সময় ডিহাইড্রেশন, ট্রাভেলারস ডায়রিয়া এবং হেপাটাইটিস বা লিভারে প্রদাহ সাধারণত অপর্যাপ্ত পানি বা অনিরাপদ খাবার ও পানীয় থেকে হতে পারে। এছাড়া হার্ট ডিজিজ বা যাদের উচ্চরক্তচাপ আছে, তাদের স্ট্রেসজনিত জটিলতা হতে পারে। তাৎক্ষণিক প্রতিষেধকের জন্য কিছু ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি ড্রাগ সঙ্গে রাখতে পারেন। এগুলো হলো জ্বর ও ব্যথা কমানোর জন্য প্যারসিটামল গ্রুপ, অ্যান্টি ডায়রিয়া জাতীয় ওষুধ, ওরস্যালাইন এবং অ্যান্টি অ্যালার্জি জাতীয় ওষুধ।
পেট খুব খারাপ হলে একটি সিপ্রোফ্লক্সাসিন জাতীয় ওষুধ ভালো কাজ দেয়। কেউ কেউ পুরো কোর্স খাওয়ারও পরামর্শ দেন। এছাড়া অ্যাজিথ্রোমাইসিন জাতীয় ওষুধও একটি খাওয়া যায়। এ ওষুধগুলো শ্বাসনালির ওপরের অংশের প্রদাহ যা ধুলোবালি থেকে হয়, তাতে ভালো কাজ দেয়। চিকিৎসা সহায়তা পাওয়ার আগ পর্যন্ত এ ওষুধগুলো তাৎক্ষণিক সুরক্ষায় কাজে দেবে।
যাদের মোশন সিকনেস অর্থাৎ গাড়িতে উঠলে বমি বা বমি বমি ভাব হয়, তারা জার্নির ৩০ মিনিট আগে স্টিমেটিল বা ম্যাকলিজিন গ্রুপের ওষুধ একটি খেয়ে নিতে পারেন। এ ওষুধ প্রায় ৮-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে।
> আনন্দদায়ক ভ্রমণে
আপনার প্রতিষ্ঠানের আইডি কার্ড থাকলে তা গলায় ঝুলিয়ে রাখুন বা শরীরের কোথাও ডিসপ্লে করুন। এটি আপনাকে অনেক বিপদ থেকে বাঁচাবে। মূল্যবান জিনিসপত্র ব্যাগে তালা মেরে চাবি হ্যান্ডব্যাগে রাখুন। এ ব্যাগে জরুরি ডকুমেন্টসগুলোও রাখুন। এ ছাড়া হ্যান্ডব্যাগে থাকবে আপনার প্রতিদিনের ব্যবহারের ওষুধপত্র। প্রি-জার্নি লিস্ট করার সময় এগুলো খেয়াল রাখতে হবে।
ভ্রমণে আরও যা করবেন
* যাদের গ্লুকোমা আছে, তারা আই গ্লাস পরে ভ্রমণ করুন।
* চোখের ইমার্জেন্সি ড্রপ নিতে ভুলবেন না। যারা লেন্স পরেন, তারা ধুলোবালি থেকে বাঁচতে লেন্স ক্লিনার সঙ্গে নিন। অনেকে সানগ্লাসও পরতে পারেন।
* ক্যাপ বা হ্যাট পরতে পারেন সূর্যের আলো থেকে রক্ষার জন্য, বিশেষ করে যেখানে এসি নেই।
* বাস-কোস্টার বা ট্রেনের বাইরে যেন বাচ্চা বা কেউ হাত বা মুখ না দেয়, সেদিকে নজর রাখুন।
* সিটবেল্ট বেঁধে ভ্রমণ করা উত্তম। খুব ছোট বাচ্চার জন্য স্পেশাল কট ব্যবহার করা যায়।
এ ছাড়া বিদেশের কিছু কিছু জায়গায় যাওয়ার আগে ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস ও টাইফয়েডের ভ্যাকসিন নিয়ে নেওয়া উচিত। ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলারস গাইড থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।
> ঈদের সকাল
যেহেতু পুরো এক মাস একই নিয়মে রোজা রাখার পর ঈদের সকালে প্রথম খেতে হচ্ছে, সেহেতু হঠাৎ বেশি খাবার খেয়ে ফেলা ঠিক নয়। পরিমাণে বেশি খেয়ে ফেললে বদহজম, পেটে অস্বস্তিসহ আরো নানা সমস্যা হতে পারে। কিন্তু তার আগে জানা দরকার, ঈদের দিন সকালে খাবার মেন্যু কী হওয়া উচিত।মনে রাখতে হবে, ঈদের দিন সকালের খাবার মেন্যু যাতে একটু হালকা হয়, সে ক্ষেত্রে ফিরনি হতে পারে খুব ভালো মেন্যু। দুধ, চাল ও গুড় দিয়ে ঘরেই তৈরি করে নিতে পারেন ফিরনি, যা থেকে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও মিনারেলস পাওয়া যায়। দুধের বানানো যেকোনো রেসিপি প্রোটিনের পাশাপাশি ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ করতে সাহায্য করবে। ফলের জুস বা ফল থাকতে পারে সকালের খাবার মেন্যুতে।এ ছাড়া তেলছাড়া পাতলা পরোটা আর সবজিও হতে পারে ভালো মেন্যু। সারা দিন অনেক খাবার খেলেও মেন্যুতে সবজি থাকে না বা কম থাকে। তাই সকালেই সবজি খেয়ে নিলে দৈনিক সবজির চাহিদা কিছুটা হলেও পূরণ হবে বৈকি।তবে ঈদের দিন ডিম না খাওয়াই ভালো। কেননা এই উৎসবে মাংস খাওয়া হয় বেশি।তাই ডিম না খেলে পুষ্টির একটা ব্যালান্স থাকে।
> ঈদের দুপুর
এক মাস রোজার পর ঈদের দিন দুপুরে খাবার মেন্যুতে অনেক বেশি আইটেমের খাবার না রাখাই শ্রেয়। বরং দুই থেকে তিনটি খাবার ভালোভাবে রান্না করলে পুষ্টি, তৃপ্তি, ক্যালরি—সবই পূরণ সম্ভব। এ জন্য থাকতে পারে মাছের একটি আইটেম, যেমন—মাছের চপ বা কাটলেট, মাছের দোলমা, মাছের কোরমা, গ্রিল ফিশ বা মাছের কাবাব ইত্যাদি। এতে মাংস খাওয়ার প্রবণতা কিছুটা ঠেকানো যায়।
কার্বোহাইড্রেটের চাহিদা মেটানোর জন্য দুপুরের মেন্যুতে রাখতে পারেন সাদা পোলাও বা খিচুড়ি। তবে কেউ বিরিয়ানি করলে সাইড ডিশ যেন বেশি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সবুজ সালাদ বা টক দই ও সবজির সালাদ দুপুরের মেন্যুতে অবশ্যই রাখুন, যা ভিটামিনস ও মিনারেলস প্রদান করে।
> ঈদের রাতের খাবার
সারা দিন ঘোরাঘুরি ও নানা রকম খাওয়াদাওয়ার পর অনেকেই ঈদের দিনগত রাতে তেমন খেতে পারেন না। আবার যা খেতে পছন্দ করেন, তাও ঠিকমতো খেতে পারেন। তাই রাতের মেন্যুতে খুব বেশি আইটেম রাখবেন না। রুটি বা সাদা ভাতের সঙ্গে মুরগি বা গরুর কাবাব, সবজি বা মাংসের অন্য কোনো রেসিপি থাকতে পারে। আবার একটু ভিন্নধর্মী খাবারের স্বাদ নিতে চাইলে চায়নিজ ফুডও ঘরে তৈরি করে নিতে পারেন। কেননা এজাতীয় খাবারে তেল-মসলা কম থাকে।
> রোগীদের নিরাপদ জার্নি
প্রথমেই খেয়াল রাখতে হবে, তারা যে ওষুধগুলো নিয়মিত খাচ্ছে তা পর্যাপ্ত পরিমাণে সঙ্গে নিচ্ছে কিনা। এ ছাড়া ডাক্তারের প্রেসিক্রিপশনের ফটোকপি বা তার শট মেডিকেল হিস্ট্রি সঙ্গে থাকা ভালো। কোনো অসুবিধা হলে আশপাশের মানুষ এ কাগজ পড়ে রোগীকে উপকার করতে পারেন। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হার্ট ডিজিজ, বাতরোগের ওষুধ, অ্যাজমা বা অ্যালার্জির ওষুধ সঙ্গে নিতে ভুলবেন না। ইনহেলার, ইনসুলিন ইত্যাদিও সঙ্গে রাখবেন। ডায়াবেটিস রোগীরা লজেন্স, সুগার কিউব নেবেন। প্রেগনেন্ট যারা তাদের প্রথম ছয় মাস জার্নি করা মোটামুটি নিরাপদ। যাদের অ্যাবরশনের ইতিহাস আছে, তাদের গর্ভাবস্থায় জার্নি করা উচিত নয়। বিশেষ করে শেষ তিন মাস যে কোনো গর্ভবতীর জার্নি নিষেধ। যে কোনো ধরনের জার্নিতে তারা প্রচুর পানি খাবেন। প্লেনে জার্নি করলে ঘন ঘন পা মেসেজ করতে হবে, না হলে পায়ে রক্ত জমাট বেঁধে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস বা ডিভিটি হতে পারে। তারা পায়ে রক্তজমা প্রতিরোধকারী মোজা পরতে পারেন। যাদের ওজন বেশি, তারাও এ কাজটি করতে পারেন।তাই এই সময়ে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সবাইকে যথেষ্ট যত্নবান ও সতর্ক হতে হবে। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে প্রতিকার নয় এসব ক্ষেত্রে প্রতিরোধ সর্বদা উত্তম।সবাইকে অগ্রিম ঈদের শুভেচ্ছা। এবারের ঈদ হোক সবার জীবনে আনন্দের উৎস।
মন্তব্য